বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি- মুহাম্মদ আব্দুল মুমীত-বাগমারা টাইমস
মাহফুজুর রহমান প্রিন্স স্টাফ রিপোর্টারঃ
ব্যবস্থাপনা কমিটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য একটি অঙ্গ। স্বপ্নের শিক্ষালয় বাস্তবায়নে একটি কার্যকরী ব্যবস্থাপনা কমিটির কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশর শিক্ষা ব্যবস্থায় দুই ধারার শিক্ষালয় বিদ্যমান, একটি সরকারি অন্যটি বেসরকারি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পূর্ণ সরকারি নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হলেও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ব্যবস্থাপনা কমিটি অর্থাৎ ম্যানেজিং কমিটি (স্কুল ও মাদ্রাসা) বা গভর্ণিং বডি (কলেজ ও আলিম হতে কামিল স্তরের মাদ্রাসা) কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রায় ২৮ হাজারের বেশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এইভাবে ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্ণিং বডি কর্তৃক দীর্ঘ দিন যাবৎ পরিচালিত হয়ে আসছে।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সঠিক পথে যথানিয়মে পরিচালিত করতে ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্ণিং বডির (পরিচালনা পর্ষদ) একান্ত প্রয়োজন। একটি কার্যকরী ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্ণিং বডি-ই পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যথাযথ পরিচালনার মাধ্যমে একটি সুন্দর শিক্ষার পরিবেশ উপহার দিতে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ও প্রশাসনিক সবক্ষেত্রেই ম্যানেজিং কমিটির রয়েছে অবাধ ক্ষমতা। ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্ণিং বডি ছাড়া প্রতিষ্ঠানের কোন প্রকার উন্নয়ন মূলক কাজ পরিচালিত হতে পারে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামাজিক যে দায়বদ্ধতা রয়েছে তা পুরোপুরি সামাল দেন ম্যানেজিং কমিটি, ক্ষেত্র বিশেষে শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যাপারেও কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, যা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের জন্য অতীব জরুরী। স্থানীয় যেকোন প্রকার উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ম্যানেজিং কমিটি অগ্রণী দায়িত্ব পালন করে থাকে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক, একাডেমিক, আর্থিক, সংস্থাপনসহ সকল প্রকার উন্নয়নমূলক কাজের দেখভাল করে থাকে ম্যানেজিং কমিটি বা গভণিং বডি। বর্তমানে এনটিআরসিএ গঠিত হওয়ায় সংস্থাপনের কাজ অনেকটা এনটিআরসি-এর নিয়ন্ত্রণে গেলেও প্রতিষ্ঠানের লাভজনক পদ দুটিসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনো ম্যানজিং কমিটি বা গভর্ণিং বডির উপর-ই ন্যাস্ত রয়েছে। ম্যানেজিং কমিটি যদি প্রতিষ্ঠান বান্ধব অর্থাৎ এর সদস্যবৃন্দ যদি শিক্ষা বান্ধব হোন তাহলে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়ন অবশ্যাম্ভাবী, অন্যথায় ভিন্ন চিত্র পরিলক্ষিত হতে বাধ্য। বর্তমান সময়ের ম্যানেজিং কমিটিতে তা সুস্পষ্ট, যারা নিজদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে কেবলই নিয়োগ ও আর্থিক চিন্তার নিগড়ে আবদ্ধ করে ফেলেছন। এর বাইরেও যে কোন কর্তব্য রয়েছে সেদিকে তাদের কোন ভ্রক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না! ফলশ্রুতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক ধরনের অসম শিক্ষার পরিবেশ দৃশ্যমান। অথচ বিদ্যালয়ের আর্থিক বিষয়, বিশেষ করে আয় বৃদ্ধি ও ব্যায় হ্রাসের ক্ষেত্রে ম্যানজিং কমিটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে ম্যানজিং কমিটির বিচক্ষণতার পরিচয় প্রতিষ্ঠানে অগ্রণী ভূমিকা পালন একান্ত অপরিহার্য।
একবিংশ শতাব্দিতে এসে ডিজিটালের পথে দেশ এগিয়েছে অনেক দূর। তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি যেমন হয়েছে, শিক্ষাক্ষেত্রেও অর্জিত হয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, পুরাতন প্রতিষ্ঠানের নতুন ভবন নির্মাণসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ উন্নয়নের ইঙ্গিতই বহন করে, কিন্তু মানের দিকে আমরা এখনো কাঙ্খিত মানে পোঁছাতে পারিনি। এর নানাবিধ কারণের মধ্যে ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্ণিং বডি অন্যতম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানও বটে। এদেশের প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই স্থানীয় প্রয়োজনে ব্যক্তি বিশেষের উদ্যাগে গড়ে উঠেছে, এভাবেই গড়ে উঠার কারণে আদিকাল থেকেই বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্ণিং বডিই মূখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু সরকার ১৯৮০ সাল থেকে এমপিওভূক্তিকরণ শুরু করে ২০০৪ সাল থেকে শতভাগ বেতন ভাতা প্রদান করলেও ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথা পদ্ধতির বিলুপ্তি বা সংশোধন তেমন দৃশ্যমান হয়নি আজ অবধি।
বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ১৯৭৭ সালে বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গভর্ণিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালা প্রণয়ন করা হয়, যা সর্বশেষ ২০০৯ সালে সংশোধন করা হয়। প্রবিধানমালায় ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্ণিং বডির দায়িত্বের মধ্যে- তহবিল সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা, শিক্ষক নিয়োগ, সাময়িক বরখাস্ত ও অপসারণ, বার্ষিক বাজেট অনুমোদন, ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা বেতনে অধ্যয়ন মুঞ্জুরী, ছুটির তালিকা অনুমোদন, স্টাফদের বাসস্থান ও শিক্ষার্থীদের হোস্টেলের ব্যবস্থা করা, জমি, ভবন, খেলার মাঠ, বই, ল্যাবরেটরি, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন ধরনের আর্থিক তহবিল গঠন ও রক্ষণাবেক্ষণ, স্কুলের সম্পত্তির কাস্টডিয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্য প্রদান নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের নিয়ে প্রি-সেশন সম্মেলনের ব্যবস্থা করা। প্রবিধানমালায় ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্ণিং বডির ষোলটি দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও বর্তমানে বেশির ভাগ দায়িত্বই সরকার পালন করে থাকেন।
১৯৭৭ সালের বাস্তবতায় প্রবিধানটি প্রযোজ্য হলেও বর্তমানের নিরিখে তা কতটুকু বাস্তবসম্মত!, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। আগের দিনে ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির কেউ আসতে চাইতো না, অনকটা চাপ প্রয়োগে বা বাধ্য করেই সমাজের সম্মানিত বা অবস্থাশালী দানশীল ব্যক্তিবর্গকে ম্যানেজিং কমিটিতে নিয়ে আসা হতো। তখনকার দিনে সবায় অনুধাবন করতেন তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং সম্মানের বিষয়টি, আর এও ভাবতেন অনেক বড় গুরু দায়িত্বের জন্য তিনি কতটুকু মানানসই বা যোগ্য। কমিটিতে যাঁরা অন্তর্ভুক্ত হতেন তাঁরা সদা সচেষ্ট থাকতেন প্রতিষ্ঠানের উন্নতি কিভাবে করা যায় সেই চিন্তায়। সভাপতি মহোদয়ের বা প্রধান শিক্ষকের এক অন্যের সাথে অন্যান্য শিক্ষক বা কমিটির অন্যান্য সদস্যকে পাশ কাটিয়ে বিশেষ কোন যোগাযোগের প্রয়োজন পরত না। অথচ এখন? ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্ণিং বডির সদস্য বা সভাপতি হলে কোন বেতন ভাতা বা সম্মানী অথবা দৃশ্যমান বিশেষ কোন সুবিধাদির ব্যবস্থা নেই, তারপরও অনেকের এত আগ্রহ কেন কমিটিতে আসার? কমিটিতে আসার জন্য বা সভাপতি হওয়ার জন্য এতটাই প্রতিযোগিতার পরিবেশ কায়েম হয়, যেখানে কর্তৃপক্ষের হিমশিম খেতে হয় পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে। কখনো কখনো উদ্ভূত পরিস্থিতি এতটাই উৎকট আর বীভৎস রূপ ধারণ করে যে, পুলিশকেও হিমশিম খেতে হয় পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে, অনেক ক্ষেত্রেই তা মামলা মোকর্দ্দমার পর্যায় পর্যন্ত গড়ায়। আমাদের দেশে দানশীল আর জনহিতৈষী ব্যক্তির যদি এতটাই আধিক্য হয়ে থাকে, তাহলে মানুষ গড়ার পবিত্র কারখানায় এসে হুমরী খেয়ে না পড়ে দেশের অনেক অসহায় আর চাহিদার খাত রয়েছে সেখানই গেলেই তো হয়? যায় না! কারণ খুবই স্পষ্ট, এখানে যত সহজে সেবা দেওয়া যায় অন্যখানে এতটা সহজ নয়, আর সহজ নয় বলেই সবার লোলুপ দৃষ্টি তিমি মাছের মতো হা করে থাকে শিক্ষা খাতের মতো অতি মূল্যবান ও মানুষ গড়ার কারিগরদের সেবা দেওয়ার জন্য!
এসডিজি-৪ বাস্তবায়ন করতে হলে মানসম্মত শিক্ষা যে কোন মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। মানসম্মত শিক্ষার যে প্যারমিটারগুলো রয়েছে, তার প্রত্যকটির সাথেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবস্থাপনা কমিটি জড়িত। ভালো শিক্ষক, দক্ষ সহায়ক কর্মচারী এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মূল কান্ডারী অর্থাৎ প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক পেতে ম্যানেজিং কমিটির স্বছতা, জবাবদিহিতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়ার কোন বিকল্প নেই। প্রতিষ্ঠানের ভালো পড়াশোনা, সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলীসহ শিক্ষক-অভিভাবক যে সম্পর্ক- তা মধুর ও প্রতিষ্ঠান বান্ধব করার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটির অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। মনে রাখতে হবে শুধু সংস্থাপন, আথির্ক আর উন্নয়ন মূলক কাজ দেখভাল-ই ম্যানেজিং কমিটির কাজ নয়, বরং আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য রয়েছে সেগুলির দিকে মনোযোগের ঘাটতি দেখা দিলে সামগ্রীক শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হতে বাধ্য, যা বর্তমান সময়ের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে বৈকি!
শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের নিমিত্ত ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্ণিং বডিকে একটি নির্দিষ্ট ফ্লেমের মধ্যে নিয়ে আসা প্রয়োজন। তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ জবাবদিহিতার একটা ফিরিস্তিও থাকা আবশ্যক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীর মতে- নিয়মতান্ত্রিক পরিচালনার জন্য একটি সীমিত পরিসরের কমিটি থাকতে পারে, যাতে কারও কোন সমস্যা হলে কমিটির কাছে অভিযাগ করতে পারে। তবে আমরা সবচেয়ে খুশি হতাম, যদি সব মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত হতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়ম তদন্তের দায়িত্ব পালনকারী সংস্থা পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) এর মতে ম্যানেজিং কমিটির জবাবদিহিতা থাকলে প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ অনিয়মই অঙ্কুরে বিনিষ্ট করা সম্ভব। ব্যবস্থাপনা কমিটি যাদেরকে পরিচালনা করবে তাঁদের যদি জবাবদিহিতা থাকে, তাহলে কমিটির থাকবে না কেন? এ কেমন নিয়ম! বিষয়টি সময়ের প্রয়াজনে ভেবে দেখা যেতে পারে। প্রয়োজনের নিরিখে কমিটির মেয়াদ দুই বছর থেকে বাড়ানো এবং রুপরেখা তের সদস্য হতে কমানো যেতে পারে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সামাজিক প্রতিষ্ঠান, তাই ইহার ব্যবস্থাপনা কমিটিকে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা সকল প্রকার রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হতে দূরে রাখতে পারলে শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফল হবে এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতৃত্বে সুশিক্ষকের সুশিক্ষায় সুনাগরিক গড়ে উঠবে, যারা আগামীর সোনার বাংলা বিনির্মাণে অগ্রণী ভুমিকা রাখবে- এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।
লেখক ও গবেষক
মুহাম্মদ আব্দুল মুমীত